ডিভোর্স কি?
ডিভোর্স বা তালাক একই বিষয়, বাংলা ও ইংরেজির আলাদা দুটি শব্দ। ডিভোর্স রেজিস্ট্রার হতে পারে আবার নাও হতে পারে। আরেকটি ডিভোর্স বা তালাক রয়েছে যেটি রেজিস্ট্রার হয়ে থাকে।
মনে করুন রেজিস্ট্রার ছাড়া ডিভোর্স এটা গরীব দেয়, আর রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে ডিভোর্স শিক্ষিতরা দেয়।
রেজিস্ট্রার ছাড়া ডিভোর্স এটা সকালে রাগের মাথায় মুখে মুখে দিয়ে রাতেই আবার হুশ ফিরে এলেই বাদ হয়ে যায় আর রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে ডিভোর্স এক্কেবারে পার্মানেন্ট আর চান্স নেই।
যেমন ধরুন আইন তালাক, বাইন তালাক, গাইন তালাক এর পর সাইন আর রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে ডিভোর্স একবারে সাইন। অবাক হলেও সত্য রেজিস্ট্রার ছাড়া ডিভোর্স এটা বেশিরভাগ পুরুষ দেয় আর রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে ডিভোর্স বেশিরভাগ নারীরা দেয় ।
এই লেখা ডিভোর্স দেয়ার নিয়ম, ডিভোর্স বিষয়ক আইন সম্পর্কে লেখা হয়েছে।
রেজিস্ট্রার ছাড়া ডিভোর্স এটা বেশিরভাগ সময় দেওয়া হয় রাগের মাথায়, আর রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে ডিভোর্স দেওয়া হয় অভিমান করে এরপর ভেবে চিন্তে। মূল কথা হলো ডিভোর্স বা তালাক দেওয়ার পদ্ধতির ক্ষেত্রে আসলে কোনই পার্থক্য নেই, দুটোই মর্মান্তিক। দুটোই বিচ্ছেদ।
তালাক কি?
বিবাহ-বিচ্ছেদ বা “Divorce” এর বাংলা শব্দ তর্জমা আর আরবি শব্দ “তালাক” । বিবাহ-বিচ্ছেদ বা তালাক বা ডিভোর্স এর অর্থ হলো কোনোকিছুকে ভেঙ্গে ফেলা বা বিচ্ছিন্ন করা। এটিকে একপ্রকার বিবাহ-বিচ্ছেদই বলা হয় কিন্তু তা শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়।
মনে করুন রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও পরিচালিত আইন মেনে চলে যে বিবাহ-বিচ্ছেদ সম্পাদিত হয় সেটিকে বলা যায় সাধারণ বিবাহ-বিচ্ছেদ । অপরদিকে ইসলামের ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসারে যে বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পাদিত হয় মূলত তাকে তালাক বলা হয়।
তালাক একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া যেটি সম্পূর্ণ কার্যকর হয় তিনটি পর্যায় এবং ৯০ দিনঅতিবাহিত হবার মাধ্যমে।
ডিভোর্স মামলার ধরন ও নিয়মঃ
বিবাহ ও ডিভোর্স সংক্রান্ত অপরাধ ঘটলে সরাসরি আদালতে মামলা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মামলার প্রমাণ হিসেবে বিয়ের কাবিননামা ও অন্যান্য প্রমাণ সঙ্গে জমা দিতে হবে এবং আইনজীবী নিয়োগ করতে হবে।
ডিভোর্স বা তালাকের পর মামলার ক্ষেত্রে আসামি গ্রেপ্তার হলে বা সমন প্রাপ্তির পর আদালতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করলে আসামিপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী বিজ্ঞ আদালতে জামিন শুনানীতে এই বলে বক্তব্য পেশ করেন যে, বাদিনী তালাকের নোটিশ প্রাপ্তির পর আসামির প্রতি রাগান্বিত ও প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে আমার মক্কেলের উপর হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন।
আসামী পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীর এ বক্তব্যের সমর্থনের উপর বিজ্ঞ আদালতে সমিপে ফিরিস্তি আকারে তালাক প্রদানের নোটিশ, ডাক রসিদ, প্রাপ্তি স্বীকারসহ উপযুক্ত প্রমাণ পেশ করে থাকেন।
বিজ্ঞ আদালত সার্বিক দিক বিবেচনা করে এবং তালাকের পর মামলা সম্পর্কিত উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে আসামিকে জামিনে মুক্তির আদেশ দিয়ে থাকেন।
অতঃপর মামলাটির পরবর্তী ধাপে চলে যায় সংশ্লিষ্ট ধারায় অভিযোগ গঠন বিষয়ের উপর। চার্জ গঠন বিষয়ে শুনানির সময় আসামি পক্ষে বিজ্ঞ আইনজীবী বিচারকের নিকট মামলার অব্যাহতি চেয়ে বিজ্ঞ আদালতে আবেদন পেশ করেন। উক্ত অব্যাহতির আবেদন এবং শুনানীতে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেন স্ত্রীকে তালাকের পরে যদি মামলা দায়ের করা হয় সেই ক্ষেত্রে উক্ত মামলাটি অচল হবে এবং আসামি অব্যাহতি বা খালাস পাবেন।
ডিভোর্স বা তালাকের পর স্ত্রী কর্তৃক নারী নির্যাতন বা যৌতুকের মামলা হলে চিন্তিত না হয়ে আইন -আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মামলাটিতে চালিয়ে যান। স্ত্রী ডিভোর্স বা তালাকের নোটিশ প্রাপ্তির পর থানা বা আদালতে গিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(গ)/৩০ ধারায় বা যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ধারায় মামলা করে থাকেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে যৌতুক সংক্রান্ত ১১ (গ)/৩০ ধারাটি এবং যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ধারাটিও আপসযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কাজেই আপনার বিরুদ্ধে মামলা হলে এজাহারের কপিটি সংগ্রহ করে রাখুন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগটির সত্যতা না পেলে তদন্ত শেষে আপনাকে নির্দোষ দেখিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন অর্থাৎ ফাইনাল রিপোর্ট আদালতে দাখিল করতে পারেন। আর জামিন না-হলে পর্যায়ক্রমে উচ্চ আদালতে জামিন আবেদন করতে পারেন।
এ ছাড়া আপনি মিথ্যা মামলা থেকে অব্যাহতির জন্য আবেদন করতে পারেন। অব্যাহতির আবেদন নাকচ হলে উচ্চ আদালতে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করতে পারেন।
যদি থানায় মামলা না হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল মামলা হয়, সে ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল মামলাটি তদন্ত বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করতে পারেন।
এছাড়াও ডিভোর্সের মামলা সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করুন তারপর মামলার পরবর্তী পদক্ষেপ অনুসরণ করুন।
আরো জানুনঃ লিমিটেড কোম্পানি করার নিয়ম, খরচ, রেজিস্ট্রেশন, সুবিধা অসুবিধা
ডিভোর্স দেয়ার নিয়ম ও আইনঃ
ডিভোর্স স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ দিতে পারেন। মনে রাখতে হবে স্ত্রী ডিভোর্স দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি শর্ত রয়েছে।
যদি বিবাহ নিবন্ধনের সময় নিকাহনামার ১৮ নং কলামে স্ত্রীকে ডিভোর্সের অধিকার দেওয়া হয় তাহলে স্ত্রী ডিভোর্স দিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে স্বামীর জন্য যে পদ্ধতি বলা হয়েছে, একই বিধান স্ত্রীর জন্যও প্রযোজ্য হবে।
যদি বিবাহ নিবন্ধনের সময় নিকাহনামার ১৮ নং কলামে স্ত্রীকে ডিভোর্সের অধিকার দেওয়া না হয় তাহলে স্ত্রী ডিভোর্স দিতে পারবেন না। ডিভোর্সের অধিকার না দেওয়া থাকলে উক্ত স্ত্রী পারিবারিক আদালতে আবেদন করে ডিভোর্স দিতে পারবেন।
বাংলাদেশে ডিভোর্সের আইনি প্রক্রিয়াঃ
স্বামী বা স্ত্রী যে পক্ষই তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিবে তাকে অবশ্যই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান , পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের মেয়রকে লিখিতভাবে তালাক নোটিশের কপি পাঠাতে হয়। সে সাথে স্বামী বা স্ত্রীকেও তালাক নোটিশের কপি পাঠাতে হয়।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান , পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের মেয়র বরাবর নোটিশপ্রাপ্তির তারিখ থেকে ৯০ দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো ভাবেই বিবাহ-বিচ্ছেদ কার্যকর হয় না।
তালাকের নোটিশ প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান , পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের মেয়র সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আপস বা সমঝোতার উদ্দেশ্যে সালিসি পরিষদ গঠন করবেন।
এই সালিসি পরিষদ দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করবেন। ৩০ দিন সময় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান , পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের মেয়র কর্তৃক নোটিশপ্রাপ্তির তারিখ থেকে হিসাব করতে হবে।
উভয়ের সম্মতিতে ডিভোর্সঃ
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত হচ্ছে ‘খুলা’ তালাক। এই পদ্ধতিতে স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ের সম্মতিতে স্ত্রীর ধার্য্যকৃত দেনমোহর ও ভরণপোষণ প্রদান করে একই বৈঠকে বিবাহবিচ্ছেদ করে তা রেজিস্ট্রেশন করা হয়। এ ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান , পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের মেয়র বরাবর ৯০ দিনের নোটিশ প্রদানের প্রয়োজন হয় না।
তবে এই পদ্ধতিতে বিবাহ-বিচ্ছেদের পর স্ত্রীর অন্য কোথাও নতুন করে বিয়ে করার ক্ষেত্রে পদ্ধতি হলো স্ত্রী ইদ্দতকালীন তিন মাস সময় পার করার পর নতুন করে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবেন।
আদালতের মাধ্যমে ডিভোর্সঃ
যখন আদালতের মাধ্যমে ডিভোর্স দিতে হয়। বিবাহ-বিচ্ছেদ বা তালাকের ক্ষেত্রে মুসলিম পারিবারিক আইন অনুসারে স্বামী তাঁর স্ত্রীকে ডিভোর্স দিতে চাইলে আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না কিন্তু স্ত্রীর ক্ষেত্রে নিকাহনামার ১৮ নং কলামে ডিভোর্স দেওয়ার অধিকার না দেওয়া থাকলে বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য স্ত্রীকে পারিবারিক আদালতে আবেদন করতে হয়।
১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন অনুসারে স্ত্রী পারিবারিক আদালতে বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারবেন। যদি পারিবারিক আদালত বিবাহ-বিচ্ছেদের ডিক্রি প্রদান করেন তাহলে আদালতের ডিক্রি প্রদানের সাত দিনের মধ্যে একটি সত্যায়িত কপি পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান , পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের মেয়রের কাছে পাঠানো হবে।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান , পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের মেয়র যেদিন নোটিশটি পাবেন, সেদিন থেকে ঠিক ৯০ দিন পর তালাক চূড়ান্তভাবে কার্যকর হয়ে যাবে।
স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা থাকলে তালাকের নিয়মঃ
যদি তালাক প্রদান করার সময় স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা থাকেন, সে ক্ষেত্রে নিয়ম হলো তালাকের নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন পরও যদি স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা থাকেন, তাহলে সন্তান যেদিন ভূমিষ্ঠ হবে, সেদিন তালাক কার্যকর হয়ে যাবে ।
অপরদিকে স্ত্রীকে তালাকের নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন আগেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়, তবে স্বাভাবিক নিয়মের মাধ্যমে অর্থাৎ ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হবে।
তালাক সম্পন্ন হবার পর আগের স্বামী – স্ত্রীকে পুনরায় বিবাহঃ
যদি ডিভোর্স কার্যকর হয়ে যায় তাহলে ডিভোর্স দেওয়া স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করতে চাইলে আপনাকে পুনরায় আগের মতো নিয়ম কানুন মেনে বিয়ে করতে হবে।
অপরদিকে যদি এমন হয় যে ডিভোর্স দেওয়ার নিদিষ্ট সময় ৯০ দিন অতিবাহিত হয় নাই সেক্ষেত্রে ৯০ দিন অতিবাহিত না হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত যে কোন দিনের মধ্যে তালাক দেওয়া স্বামী বা স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে তালাক প্রত্যাহার করে নিলেই বিবাহ বলবৎ থেকে যাবে।
লেখক: এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম,
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
ডিভোর্স আইন সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন www.lawfornations.com এর সাথেই থাকুন। যোগাযোগঃ- lawfornations.abm@gmail.com, মোবাইল: 01842459590-01711459590